মো: শামীম আখতার |
আজ (২৮মার্চ) রংপুর ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে তীর-ধনুক, দা-কুড়াল, বল্লম ও বাঁশের লাঠি নিয়ে রংপুর ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করে পাক হানাদারদের উপর হামলা চালায় রংপুরের সাধারণ মানুষ। এতে অংশ নেয় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও সাঁওতালসহ কয়েক হাজার বাঙালি। সেদিন এই অসম যুদ্ধে নিরস্ত্র মুক্তিকামি দেড় হাজারেরও বেশি মানুষ পাক-হানাদারদের গুলিতে শহীদ হন। আহত হন সহস্রাধিক মানুষ। এসব শহীদ পরিবার ও আহত ব্যক্তিদের খোঁজ রাখে না কেউ। অনেক আহত ব্যক্তি পঙ্গুত্ববরণ করে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন।
দিবসটি পালনের লক্ষে গতকাল বুধবার দুপুরে প্রস্তুতিমূলক সভা করেছে মোখতার এন্টারপ্রাইজ।
জানা যায়, ২৪ মার্চ মধ্যরাতে রাজাকারদের সহযোগিতায় ক্যান্টনমেন্টের পাশের গ্রাম নিসবেতগঞ্জ ও দামোদারপুরের অনেক মানুষকে গুলি করে হত্যা করা হয়। সেই সাথে জ্বালিয়ে দেওয়া হয় কয়েকটি গ্রাম। ২৫ মার্চ দুপুরে ৩২ জনকে দড়ি দিয়ে বেঁধে লাহিরীরহাটের একটি মাঠে দাঁড় করিয়ে পর পর গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় মানুষ আরো বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।
এসব মানুষদের সংগঠিত করেন তৎকালীন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক সিদ্দিক হোসেন, আব্দুল গণি, তৈয়বুর রহমান, মুখতার এলাহি, আবুল মনছুর, ইছহাক চৌধুরী, ন্যাপ নেতা সামছুজ্জামান ও কমিউনিষ্ট নেতা ছয়ের উদ্দিনসহ আরো অনেকে। শুরু হয় রংপুর শহরে সেনাবাহিনীর মহড়া। এ পর্যায়ে ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করে অবাঙালি সৈন্যদের বন্দি করে ক্যান্টনমেন্ট দখল করার সিদ্ধান্ত হয়। ধীরে ধীরে রংপুর উত্তপ্ত হতে থাকে।
ওই দিন নিসবেতগঞ্জ গ্রামের চৌধুরী বাড়ির কাছে নিচু জমিতে জিপ ফেলে দিয়ে আর্মি অফিসার আব্বাসীকে দা’ দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে স্থানীয় শাহেদ আলী নামে একজন। এ দুঃসাহসিক অভিযানে অংশ নেন আব্দুর রউফ ও আব্দুল হান্নানসহ অনেক সাহসী সন্তান। এ খবর পেয়ে সকল বাঙালি সৈন্যদের ২৭ মার্চ রাতে আটকে রেখে অস্ত্র জমা নিয়ে ইপিআর ক্যাম্পে হামলা চালায় পাক সেনারা।
এ খবর ছড়িয়ে পড়লে গ্রামের হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ মানুষ তীর-ধনুক, দা-কুড়াল, বল্লম ও বাঁশের লাঠি হাতে নিয়ে ক্যান্টনমেন্টের আশপাশের এলাকাসহ ঘাঘট নদীর তীরে জমায়েত হয়। পরদিন ২৮ মার্চ দুপুর হতেই মিঠাপুকুর, বলদীপুকুর, বদরগঞ্জ, রাণীপুকুর, মানজাইল, তামপাট, পালিচড়া, রামজীবন, বনগাঁও, বুড়িরহাট, হারাগাছ, গঙ্গাচড়া, শ্যামপুর, দমদমা, লালবাগ, গনেশপুর মামুদারপুর, দেওডোবা, পাঠানপাড়া, তারাগঞ্জ ও পাগলাপীরসহ অন্য এলাকা থেকে মানুষ ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় জমায়েত হতে থাকে। শুরু হয় পাক সেনাদের সাথে সম্মুখ লড়াই।
মিঠাপুকুর অঞ্চলের ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী ও সাঁওতালরা এই আক্রমণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। তারা কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে রংপুর ক্যান্টনমেন্টে প্রবেশের চেষ্টা করে। এ সময় ক্যান্টনমেন্ট থেকে আসতে থাকে বৃষ্টির মত গুলি। গুলিবিদ্ধ হয়ে সেখানেই শহীদ হন দেড় হাজারেরও বেশি মানুষ। আহত হন কয়েক হাজার।
ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করতে গিয়ে পাক সেনাদের গুলিতে নিহত হন রাণীপুকুর ইউনিয়নের দৌলত নূরপুর গ্রামের আয়নাল হক। তার স্ত্রী রওশনা বেগম জানান, বাঁশের কঞ্চি দিয়ে তৈরী তীর-ধনুক নিয়ে রংপুর ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করতে গিয়ে পাকসেনাদের গুলিতে ঘটনাস্থলেই তিনি (আয়নাল) মারা যান। পরদিন কয়েকজন প্রতিবেশি কাঁধে করে তার লাশ বাড়িতে নিয়ে আসে।
ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করতে গিয়ে পাক সেনাদের গুলিতে আহতদের একজন রাণীপুকুর ইউনিয়নের নাসিরাবাদ গ্রামের মৃত. মমদেল হোসেনের ছেলে মনছুর আলী। ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করতে গিয়ে গুলিতে আহত হয়ে পঙ্গুত্ববরণ করেন তিনি। বর্তমানে অন্যের উপর নির্ভর করে চলছে তার সংসার।
মনছুর আলী দুঃখ করে বলেন, দেশকে হানাদারমুক্ত করতে আমরা গিয়েছিলাম পাক সেনাদের আক্রমণ করতে। আমাদের হাতে ছিল তীর-ধনুক আর বুকে ছিল দেশ স্বাধীন করার মনোবল। আমরা গুলিবিদ্ধ হয়ে ফিরে আসলেও অনেকে শহীদ হয়েছেন সেদিন। আমাদের খোঁজ-খবর নেওয়ার মত এখন কেউ নেই। এ পর্যন্ত নাম ওঠেনি মুক্তিযোদ্ধার তালিকায়।
এদিকে, ২৮মার্চ রংপুর ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও দিবস উদ্যাপনের লক্ষে গতকাল বুধবার দুপুরে প্রস্তুতিমূলক সভা করেছে মোখতার এন্টারপ্রাইজ। রাণীপুকুর প্রধান কার্যায়ে এই সভা অনুষ্ঠিত হয়।
এম২৪নিউজ/আখতার