নূরুল ইসলাম বরিন্দী ।।
স্মৃতির স্বচ্ছতোয়া সরোবরে সাঁতার কাটতে কাটতে আনমনা হয়ে অনেকদূর পর্যন্ত হেঁটে এসেছি আমি। সামনেই শীর্ণকায়া যমুনেশ্বরী নদী। আজও তেমনি শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়িয়ে আছে বাঁশের সাঁকোটা। বর্ষা মৌসুমে এর কোনো অস্তিত্ব না থাকলেও শীতকালে নদীর পানি হাঁটুজল হলে এর প্রয়োজন হয়ে পড়ে অনিবার্যভাবে। ভরা বর্ষায় পারাপার চলে পানসি নৌকায়।
পেছনে চাঁদটা ঊঠে এসেছে অনেকদূর ওপরে। স্পষ্ট নয়, আবছা কুয়াশার অন্ধকারে ডানদিকে চোখে পড়ছে হাইস্কুলের পুরনো বিল্ডিং। আশেপাশে বন-জঙ্গল, বাঁশঝাড়ের ছায়া ছায়া অন্ধকার। ওপারে বালাগঞ্জের শ্মশান ঘাটের ভূতুড়ে নিস্তব্ধতা। বাতাসে ভেসে আসছে ঝিঁ ঝিঁ পোকার অবিরাম আওয়াজ। মাঝে মাঝে কুকুরের ঘেউ ঘেউ ডাক। মাইলটাক দূরত্বের রেল লাইন দিয়ে সিটি বাজিয়ে ঝিক ঝিক চলে গেলো তিস্তা-করোতোয়া রাজধানী এক্সপ্রেস।
নদী পার হয়ে, শ্মশান ঘাট বামে রেখে স্কুলে যাওয়া-আসার পায়েচলা সরু পথটা ধরে রাস্তার মাথায় বড়ো বটগাছটার নিচে এসে থমকে দাঁড়ালাম আমি। লতাগুল্ম ঝুলে আছে গাছটার চারপাশে। এখনো কী স্কুলফেরত ছেলে-মেয়ের দল চৈত্রের দুপুরে দোল খায় বটের লতায়? কিংবা ছায়াদার ধুলো মাটিতে দাগ কেটে এক্কা-দোক্কা খেলে দুরন্ত ডানপিটে ছেলে-মেয়েরা? এসব আকুলি বিকুলি নানান প্রশ্নের জাবর কাটতে কাটতে বটগাছের সীমানা ছাড়িয়ে মামা বাড়ির পথে আনমনে হাঁটতে থাকি আমি।
চাঁদের আবছা আলো গলে গলে পড়ছে বাশঝাড়ের মাথায়। বাগদিপাড়ার বাঁকটা ঘুরলেই মামা বাড়ির উঠান। উঠানের একপাশে ছিলো একটা এঁদো পুকুর। পুকুরের গা ঘেষে ছিলো একটা বাংলোঘর। পুকুরটা আছে। ঘরটা নেই। আমি উঠানের মাঝ বরাবর চলে এলাম কম্পিত পায়ে। মামা কেমন আছেন, খালা, কুলসুম আপা, জরিনা, নাহার কেমন আছে? দখিন দুয়ারি ঘরটা ছিলো মামার। পশ্চিমেরটা বানু খালার। তেমনি দাঁড়িয়ে আছে ঘর দুটো। সেই দশ বছর আগে যেমনটি দাঁড়িয়ে ছিলো। আলোহীন থম থমে অন্ধকার উঠান পেরিয়ে নিঃশব্দে গিয়ে দাঁড়াই মামার শোবার ঘরের দরজায়। ভেতর থেকে দোয়া-কালাম পাঠ করার আওয়াজ কানে ভেসে আসে। দ্রুত নিঃশ্বাস টেনে “মামা মামা” বলে ডাক দেই। দরজার কড়া নাড়তে থাকি অনবরত।
“কে—” ভেতর থেকে ক্ষীণ কণ্ঠস্বর ভেসে আসে মামার।
“দরজা খুলুন মামা, আমি শাহেদ”—হারিকেনের নিবু নিবু আলো উসকিয়ে ধড়মড় করে উঠে বসেন মামা। বন্ধ দরজা খুলে হকচকিয়ে তাকান বাইরের দিকে। আমাকে দেখেই আবেগে প্রায় চিৎকার করে ওঠেন—“শাহেদ, এতোদিন পরে কোথা থেকে এলে বাবা!”– কথা বলতে বলতে রুদ্ধ হয়ে আসে বৃদ্ধের কণ্ঠস্বর।
স্তিমিত আলোয় আলাউদ্দিন মামার দিকে চোখ পড়তেই চমকে উঠি আমি। ক্রাচে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। হাঁটুর সামান্য ওপর থেকে কেটে ফেলা ডান পাটা ঝুলছে শূন্যে। কাঁপছেন তিনি। পলকহীন দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছেন আমার মুখের দিকে।
“এ অবস্থা কেনো মামা আপনার, কী হয়েছিলো আপনার?”—আমি প্রায় চিৎকার করে উঠি। সঙ্গে সঙ্গে কোনো জবাব দিলেন না মামা। লক্ষ্য করলাম ঝর ঝর করে জল গড়িয়ে পড়ছে তার দুগণ্ড বেয়ে। বয়সের ভারে দেহে মুখে স্পষ্ট বলিরেখা।
মামার সঙ্গে কথা বলার ফাঁকে এ-ঘর ও-ঘর থেকে দুদ্দাড় দরজা খুলে ছুটে এলেন বানু খালা, নাহার। হাউমাউ কান্নার শব্দে বাতাস ভারী হয়ে উঠলো চারদিকের। আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন বানু খালা। বাল্যের নাহার এখন যৌবনের দ্বারপ্রান্তে। সে আমাকে চিনতে পারছে না। আমার কিন্তু চিনতে একটুও কষ্ট হচ্ছে না নাহারকে চিনতে। কিন্তু জরিনা, কুলসুম আপা? ওরা কোথায়? ওরা ছুটে আসছে না কেনো? নাকি বিয়ে শাদী হয়ে চলে গেছে স্বামীর ঘর-সংসার করতে? সেটাই স্বাভাবিক। গ্রামের মেয়েদের এতো বয়সে অবিবাহিত থাকার কথা নয়। মনে মনে আন্দাজ করে নেই আমি।
হঠাৎ মেয়েলি কণ্ঠের বিকট হাসির শব্দে চমকে উঠি আমি। হি হি হা হা হাসির শব্দটা ভেসে আসছে দক্ষিণের চালাঘরের ওদিক থেকে। দরজা খোলার শব্দ এবং সেই সঙ্গে বিকট হাসির আওয়াজটা এগিয়ে আসে বারান্দা বেয়ে, অন্ধকার উঠান ডিঙ্গিয়ে এদিকটায়। অস্থির উত্তেজনায় সারা দেহ থিরথিরিয়ে ওঠে আমার। আবছা আলোয় আবিষ্কার করি অসংলগ্ন হাসির মানুষটা কুলসুম আপা। তিনি পাশে এসে দাঁড়ালেন বানু খালার। হাসি থামিয়ে কিছুক্ষণ গভীরভাবে নিরীক্ষণ করলেন আমাকে। আর আমি বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকলাম অনেকক্ষণ।
বানু খালা বললেন—“চিনতে পারছিস কুলসুম, ও আমাদের শাহেদ ।” নিষ্পলক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন কুলসুম আপা। বোঝা যাচ্ছে না চিনতে পারছেন কি-না। এরপর হঠাৎ হুহু কান্নায় ডুকরে উঠলেন তিনি। আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে ফোঁপাতে থাকলেন অবিরাম। রুদ্ধ নিঃশ্বাসে চিৎকার করে উঠি আমি—“মামার একটা পা নেই। কুলসুম আপার এরকম অবস্থা। এসব কী দেখছি আমি?”
সঙ্গে সঙ্গে কেউ কোনো উত্তর দিলো না আমার কথার। আমার তীব্র কণ্ঠস্বর অন্ধকার রাতের হাওয়ায় হাওয়ায় দুলতে দুলতে ফিরে আসছে আবার আমার কানেই। অনেকক্ষণ পর নিজেকে কিছুটা আত্মস্থ করে বলতে থাকেন আলাউদ্দিন মামা—“একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে হঠাৎ একদিন বালাগঞ্জ হাইস্কুলে এসে ক্যাম্প করলো খান সেনারা। কারা যেনো ওদের খবর দিয়েছিলো এখানে ঘাঁটি গেড়েছে মুক্তিযোদ্ধারা। শুরু হলো রাজাকারদের সহযোগিতায় তাদের অপারেশন। নিজের নিজের ঘর-দুয়ার সব ফেলে কোথায় চলে গেলো মানুষজন। প্রায় জনমানব শূন্য হয়ে গেলো গোটা বালাগঞ্জ এলাকা। হানাদারদের অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র তখন আমাদের গ্রামটা। আমি আর কোথায় পালাবো? আমার তো আর কোনো জোয়ান ছেলে নেই যে মুক্তিযুদ্ধ করতে যাবে। নিজেও কোনো অপরাধ করিনি। ভাবতে পারিনি অপরাধী আর নিরপরাধীর কোনো বাছ-
বিচার নেই ওদের কাছে। ভয়ে ভয়ে দিন গুনছিলাম। হঠাৎ একদিন হানা দিলো কয়েকজন পাকিস্তানী সৈন্য। তেমন কোনো ছুঁতা না পেলেও রেহাই দিলো না ওরা। উঠানের নিমগাছটার সঙ্গে আড়মোড়া করে বেঁধে ফেললো আমাকে। নাহার লুকিয়ে ছিলো একটা ডুলির ভেতর। জরিনা এক বছর আগেই মারা গেছে সামান্য ঘুষ ঘুষে জ্বর হয়ে। কুলসুমকে দেখেই লোলুপ হয়ে উঠলো হায়েনার দল। এক এক করে পাঁচ পাঁচটা বর্বর ধর্ষণ করলো ওকে আমার চোখের সামনেই। আর বাপ হয়ে আমি সে দৃশ্য প্রত্যক্ষ
করলাম নিরবে। কুলসুমকে অজ্ঞান অবস্থায় ফেলে রেখে যাবার সময় একজন মিলিটারি হঠাৎ আমাকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লো। ডান পাটা ফুটো করে বেরিয়ে গেল বুলেট। মাটিতে লুটিয়ে পড়ার আগেও আমি শুনতে পেয়েছিলাম ওদের সম্মিলিত কণ্ঠের ক্রূর হাসি!
পরদিন ওরা ক্যাম্প উঠিয়ে চলে গেলো বালাগঞ্জ থেকে। ধীরে ধীরে গ্রামের মাটিতে নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে এলো লোকজন। আমি মরতে মরতেও বেঁচে গেলাম ডান পাটার বিনিময়ে। জ্ঞান ফেরার পর কুলসুম আর সেই কুলসুম থাকলো না। মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে পাথর হয়ে গেলো শোকে। সেই থেকে সে কখনো হাসে আবার কখনো কাঁদে। কখনোবা ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে আকাশের দিকে বোবা দৃষ্টি মেলে। বুঝিবা ফরিয়াদ জানায় আল্লাহ পাকের দরবারে। বিচার চায় তার কাছে। ওর এই করুণ অবস্থা আমি সহ্য করতে পারি না বাবা। কেনো দুশমনদের গুলিটা আমার বুক ভেদ করে গেলো না। কেনো আমি এই পাশবিকতার নিরব সাক্ষী হয়ে বেঁচে থাকলাম বাবা!” — বুকফাটা কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন মামা। আহা! চিরকালের নির্বিরোধী মানুষটার এমন দশা! বুকের গহিন তলদেশ থেকে প্রবল বেগে রক্তপাত হতে থাকে আমার। দুঃখের!
বিষাদের! মুক্তিযুদ্ধের করুণ পরিণতি নিয়ে বেঁচে থাকা হাজারো মানুষের মধ্যে এরাও স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষ হিসেবে বেঁচে আছে। হিরোশিমা নাগাসাকির আণবিক বোমার শিকার নয়, স্বজাতির, স্বদেশের পশুরূপী মানুষের ঘৃণ্য হামলার শিকারে পরিণত হয়েই আজ এই দুর্বিষহ অবস্থা এদের!
মামার করুণ লোমহর্ষক কাহিনি শোনার পর অনেকক্ষণ ধরে আমি নির্বাক, নিস্পন্দ দাঁড়িয়ে থাকি। কাঁপতে থাকি অস্থির উত্তেজনায়। সবাই কাঁদছে! আলাউদ্দিন মামা, নাহার, বানু খালা –সবাই! সবার চোখেই পানি! একমাত্র কাঁদছে না কুলসুম আপা। শুধু একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে আমার মুখের দিকে।
অকস্মাৎ কী যেনো হয়ে গেলো আমার ভেতরটায়। দৃঢ় পায়ে সামনে এগিয়ে গিয়ে আমি একটা হাত রাখলাম কুলসুম আপার কাঁধে। সকলের বিস্ময় বিস্ফারিত দৃষ্টির সামনে সগর্বে ঘোষণা দিলাম –“ আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে একজন নির্যাতিতার সারা জীবনের দায়িত্বভার কাঁধে নিলাম আজ, এই মুহূর্ত থেকে। এটাই হোক বালাগঞ্জে আমার শেষবারের মতো ফেরা! (সমাপ্ত)
নূরুল ইসলাম বরিন্দী, Email: nibarindi@gmail.com