ব্যক্তিগত ডায়েরি থেকে

 নূরুল ইসলাম বরিন্দী :

(’৭১-এর লিপিবদ্ধ ডায়েরির লেখাগুলো ঝাপসা হয়ে গেছে। সেগুলো উদ্ধার করে (শুধু ডিসেম্বরের) সংক্ষিপ্তাকারে এই অংশে তুলে ধরা হলো)।

০৩ ডিসেম্বর/১৯৭১ > আজ বিকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রি ইন্দিরা গান্ধী কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে ঘণ্টাব্যাপী বক্ততা করেন। রাত সাড়ে ৯টায় ঢাকায় কারফু জারি করা হয়। ভারত পাকিস্তান আক্রমণ করে। ইন্দিরা গান্ধী রাত ১২টায় দিল্লি ফিরে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন। বলা হয়ঃ পাকিস্তান বিমান বাহিনী ভারতের পাঠান কোট, আম্বালা, জম্মু, কাশ্মির, শ্রীনগর, আগ্রা, অমৃতসর, রাজস্থানে হামলা চালিয়েছে। পাকিস্তান অভিযোগ করে ভারত পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে হামলা করেছে।

০৪ ডিসেম্বর/১৯৭১ >রাত ৩টারদিকে বিমানবিধ্বংসী কামানের শব্দে ঘুম ভেংগে গেল। তিন দফা হামলা হয়েছে রাতে। সকালে কয়েকটি ভারতীয় বিমান হামলা চালায়। সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত হামলা চলে। কয়েকটি বিমানকে আকাশ থেকে বিধ্বস্ত হয়ে মাটিতে পড়তে দেখা গেল। সাইরেন বাজার সাথে সাথে বাসার পাশে খোঁড়া ট্রেঞ্চে আশ্রয় নিতে হয়।

০৫ ডিসেম্বর/১৯৭১ >আজো ঢাকায় বিমান হামলা হয়। খবরে জানা গেল রাশিয়া বাংলাদেশের পক্ষে জাতিসংঘে ভেটো দিয়েছে। রাতে মাঝে মাঝে গোলাগুলির শব্দ শোনা গেছে। খবরে জানা গেল ভারতীয় জেনারেল মানিক শ সকাল ৯টা পর্যন্ত বিমান হামলা বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন। পাকিস্তানি জেনারেল নিয়াজির আবেদনে নাকি এ ব্যবস্থা নেয়া হয়।

১৬ ডিসেম্বর/১৯৭১ >সকাল ১১টার দিকে মিত্রবাহিনী ঢাকায় প্রবেশ করে। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। জনসাধারণ দলে দলে রাস্তায় বেরিয়ে “ জয়বাংলা” ধ্বনিতে আকাশ বাতাস মুখরিত করে উল্লাসে ফেটে পড়ে। বিকালে রেসকোর্স ময়দানে পাক বাহিনী জেনারেল অরোরা ও মিত্রবাহিনীর কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে সারেন্ডার করে। আজ স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যূদয়। ৯ মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতার লাল সূর্য দেখা দিল বাংলার আকাশে! মুক্তিযোদ্ধাদের দৃপ্ত পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠল রাজধানী ঢাকা শহর!

১৭ ডিসেম্বর/১৯৭১ >ভারত একতরফাভাবে যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করে। পাকিস্তান তা প্রথমে মানেনি। পরে রাতে ইয়াহিয়া খান যুদ্ধ বন্ধ করতে বাধ্য হয়।

১৮ ডিসেম্বর/১৯৭১ >সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সারা ঢাকা শহর চষে বেড়ালাম। অলি-গলিতে অসংখ্য মানুষের গলিত মৃতদেহ! মানুষজন এসব দেখছে, শ্লোগান দিচ্ছে, কেউ উল্লাস প্রকাশ করছে, কেউবা অনুশোচনা করছে। যুদ্ধের যে কী ভয়াবহ পরিণতি চোখে না দেখলে তা বিশ্বাস করা যায় না। আমলিগোলার বাসাতেই আছি। বিকালে রেডিওতে জরুরি ঘোষণায় বলা হল ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সরকারি  কর্মচারিদের কাজে যোগদান করতে।

২১ ডিসেম্বর/১৯৭১ >পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পদত্যাগ করেছেন। রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে জুলফিকার আলী ভুট্ট শপথ নিয়েছেন। আজ থেকে ভারত-বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে ডাক-যোগাযোগ শুরু করেছে। পাকিস্তানে উপ-প্রেসিডেন্ট হিসাবে নূরুল আমিন মনোনীত হয়েছেন।

২২ ডিসেম্বর/১৯৭১ >বাংলাদেশ সরকার আজ মুজিব নগর থেকে রাজধানী স্থানান্তরের ঘোষণা দেয়। বিকালে প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজুদ্দিন আহমদ সহযোগীদের নিয়ে বিমানে ঢাকা আসেন।

২৩ ডিসেম্বর/১৯৭১ >পাকিস্তানে ভুট্টর নিদেশে বন্দী শেখ মুজিবকে কারাগার থেকে মুক্তি দিয়ে অন্তরীণ করে রাখা হয়েছে। নুরুল আমিন শপথ নিয়ে শেখ মুজিবের সাথে দেখা করেছেন। এদিকে মওলানা ফরিদ আহমদ মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ধরা পড়েছে।

২৪ ডিসেম্বর/১৯৭১ > বদর ও পাক-হানাদার বাহিনী বাংলার বহু শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক-সাহিত্যিককে গত ১৮ তাং ঢাকার রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে হত্যা করে। তাদের গলিত লাশের মধ্যে যাদের শনাক্ত করা হয় তারা হলেনঃ ঢাবির অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, ডাঃ ফজলে রাব্বি, শহিদুল্লাহ কায়সার, সিরাজুদ্দিন হোসেন প্রমুখ। বিবিসির খবরে জানা গেল শেখ মুজিবকে আজ লায়ালপুর জেল থেকে রাওয়ালপিন্ডির একটি বাড়িতে অন্তরীণ রাখা হয়েছে। ইন্দিরাগান্ধী রাষ্ট্রদূত ডিপি ধরের মাধ্যমে বেগম মুজিবকে ভারত সফরের আমন্ত্রণ জানান।

২৫ ডিসেম্বর/১৯৭১ >বড়দিন উপলক্ষে সরকারি ছুটির দিন ছিল। বরজাহান গতকাল রাজশাহী থেকে ঢাকায় এসেছে।

২৬ ডিসেম্বর/১৯৭১ >আজ রাস্তায় তাজুদ্দিন ও সৈয়দ নজরুলকে দেখলাম।

৩১ ডিসেম্বর/১৯৭১ >পাকিস্তানের সমাধির ওপর নতুন বাংলাদেশের জন্মের স্মৃতিময় বছরের শেষ দিন আজ। হাজার হাজার মানুষের আত্মত্যাগ, হাজারো মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশ ১৯৭১ সালকে ধরে রাখবে বহুকাল, বহুযুগ। সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন নিয়ে আগামীকাল থেকে শুরু হবে নতুন বছর—১৯৭২। এখন বাজে রাত ১২টা। বিদায় ১৯৭১,স্বাগত ১৯৭২!

নূরুল ইসলাম বরিন্দী, Email: nibarindi@gmail.com