শুধু বীজের জন্য করলা চাষ করে স্বাবলম্বী তারা

শামীম আখতার||

মিঠাপুকুর উপজেলার রাণীপুকুর হতে জায়গীর সড়কের নয়াপাড়া গ্রাম পার হতেই চোখে পড়বে বিস্তির্ণ মাঠ জুড়ে সবুজের সমারোহ। সড়কের দু’ধারে প্রায় ৪’শ বিঘা জমিতে করলা চাষ করেছেন কৃষকরা। সবজি হিসেবে করলা বিক্রির জন্য নয়, শুধু বীজের জন্য করলার চাষাবাদ করেছেন হাজারো কৃষক। কয়েক যুগ ধরে শুধু করলার বীজ বিক্রি করে এখন স্বাবলম্বী তারা।

সোমবার (৫ জুন) সকালে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় সড়কের ধারে বসে পাকা করলা থেকে বীজ সংগ্রহের কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষক-কৃষাণীরা। চোখ জুড়িয়ে গেছে করলা বীজ উৎপাদন প্রক্রিয়া দেখে। এসময় কথা হয় নয়াপাড়া গ্রামের কৃষক আজিজুল ইসলাম লুলু’র স্ত্রী রোকেয়া বেগমের সাথে। তার স্বামী জমি থেকে করলা তুলে আনছেন। তিনি বসে বসে ছুরি দিয়ে করলা দু’ভাগ করে বীজ সংগ্রহ করছেন।

মিঠাপুকুর (রংপুর): সড়কের ধারে বিস্তীর্ণ মাঠ জুড়ে করলার চাষাবাদ। ছবি- শামীম আখতার

রোকেয়া বেগম বলেন, “এবারে দেড় বিঘা জমিতে বীজের জন্য করলা চাষ করেছি। প্রচন্ড খরার কারণে যতটুকু আসা করেছিলাম ততটুকু বীজ পাবোনা। তারপরও দুই মন পাওয়ার আসা করছি।”

কৃষক আজিজুল ইসলাম লুলু বলেন, “প্রতি মৌসুমে বীজের জন্য করলা চাষ করি। এবার চল্লিশা (স্থানীয় জাত) জাতের করলা চাষ করেছি। করলা থেকে বীজ সংগ্রহের কাজ শেষের দিকে।”

একই গ্রামের কৃষক আনছারুল হক বলেন, “এবারে এক বিঘা জমিতে সাইটেম (স্থানীয় জাত) জাতের করলা চাষ করেছি। প্রায় এক মন বীজ পাবো আসা করছি।” তিনি জানান, এবারে বাজার ভালো যাচ্ছে। বীজের আমদানি কম হওয়ায় কেজি প্রতি বীজ বিক্রি হচ্ছে ১৮‘শ থেকে দুই হাজার টাকা।

কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রায় ৪০ বছর আগে নয়াপাড়া গ্রামে প্রথম করলা বীজ উৎপাদন শুরু করেন কৃষক হায়দার আলীর পিতা আফাজ উদ্দিন। প্রথম সময়কার দিকে নিজের জমিতে চাষাবাদের জন্য এই বীজ সংগ্রহ করা হতো। আশপাশের এলাকা থেকে করলা চাষিরা বীজ ক্রয় করতে আসেন। শুরু হয় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে করলা বীজ সংগ্রহের কাজ। অল্প সময়ে অধিক লাভজনক হওয়ায় ওই গ্রামের অন্য চাষিরাও বীজ সংরক্ষণের জন্য শুরু করেন করলা চাষ। ধীরে ধীরে এই বীজ উৎপাদন প্রক্রিয়ার প্রসার ঘটে।

হায়দার আলী বলেন, “আমার সবটুকু (৫ একর) জমিতে করলা চাষ করেছি। করলা বীজ বিক্রি করে অন্য ফসলের চেয়ে বেশি লাভ পাওয়া যায়। প্রথম দিকে আমার বাবা এই করলা বীজ উৎপাদন শুরু করেছিল। তার দেখাদেখি আশপাশের গ্রামের কৃষকেরা বীজের জন্য করলা চাষ করা শুরু করে।” তিনি আরো বলেন, “অনেক স্থানে এখন করলা বীজ উৎপাদন করা হয়। কিন্তু, রাণীপুকুর এলাকার করলা বীজ বিখ্যাত হয়ে উঠেছে। এই বীজ দিয়ে অধিক উৎপাদন সম্ভব। তাই, গাইবান্ধা, বগুড়া, রাজশাহী, নাটোর ও খুলনা সহ বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকাররা এখানে এসে করলার বীজ কিনে নিয়ে যায়।”

একই গ্রামের কৃষক রবিউল ইসলাম, নাজমুল হক, আনিছুর রহমান, সামসুজ্জামান সহ নয়াপাড়া, পাইকান, আফজালপুর, হাবিবপুর ও খাঁনাপাড়া গ্রামের হাজারো কৃষক শুধু বীজ উৎপাদনের জন্য করলা চাষ করেছেন। এসব এলাকায় স্থানীয় জাত সাইটেম, নেপা, চল্লিশা ও জংলী চাষাবাদ করা হয়। অন্যান্য জাতের চেয়ে স্থানীয় জাতের বীজে উৎপাদন ক্ষমতা বেশি বলে জানান কৃষকেরা।

মিঠাপুকুর (রংপুর): করলা থেকে বীজ সংগ্রহ করার পর পরিস্কার করে রোদে শুকানো হচ্ছে। ছবি- শামীম আখতার।

কৃষক এমদা মিয়া বলেন, “শুধু বীজ উৎপাদনের জন্য করলা চাষ করলে লাভ বেশি পাই। তাই, সবজী হিসেবে না করে প্রতি মৌসুমে আমরা শুধু বীজের জন্য করলা চাষ করি। চলতি মৌসুমে প্রতি কেজি করলা বীজ বিক্রি হচ্ছে দেড় থেকে ২ হাজার টাকা দরে। ক’মাস পেড়িয়ে গেলেই এই বীজ বিক্রি হবে ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকায়।”

মিঠাপুকুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাইফুল আবেদীন বলেন, “উপজেলার মধ্যে বেশি করলা চাষ হয় রাণীপুকুর এলাকায়। ওই এলাকার অনেক কৃষক শুধু বীজের জন্য করলা চাষ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন। স্থানীয়ভাবে উৎপাদন এসব বীজের গুনগত মান অনেক ভালো। উৎপাদন কার্যক্রম মনিটরিং করার জন্য স্থানীয় উপ-সহকারী কৃষি অফিসারকে বিশেষ ভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।”

এম২৪নিউজ/আখতার

Leave a Reply