পথশিশুরা ড্যান্ডি খায় কেন?

সালাহ উদ্দিন চৌধুরী:

রাত ১০টা। ঈদের ছুটি শেষে প্রথম দিনে রাজধানীর রাজপথগুলো ছিলো অনেকটাই নীরব। মতিঝিলে শাপলা চত্বরের সামনের ফুটওভার ব্রিজের নিচে ১০ থেকে ১২ জন শিশু-কিশোরের জটলা। সামেন এগিয়ে যেতেই তাদের আড্ডায় ছেদ পড়লো। জিজ্ঞাসু দৃষ্টি তাদের চোখে। তবে কোনো ভয় নেই। নাম জিজ্ঞেস করতেই এক এক করে তারা তাদের নাম বললো।

শাহরুখ, সালমান, সাকিব, মিশা, সোহেল, রুবেল, মৌসুমী, শাবনুর সিনেমার নায়ক-নায়িকাদের নামে নিজেরাই রেখেছে নিজেদের নাম। ঈদ কেমন কাটলো জিজ্ঞেস করতেই সমস্বরে উত্তর দিলো-‘ভালো না’। 

কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে তারা হাতবদল করছিলো গাঁজা ভর্তি সিগারেট আর ড্যান্ডির পলিথিন। কেনো এসব খাচ্ছো? জানতে চাইলে আগের প্রসঙ্গে ফিরে এলো। বললো ঈদের দিন সবাই কত আনন্দ করে। ভালো ভালো খাবার খায়। কিন্তু আমরা ছিলাম না খেয়ে। করোনার কারণে অনেকেই এবার মাংস বিতরণ করেনি। তাই মাংসও পাইনি খুব একটা। সবাই মিলে মাংস পেয়েছি দুই কেজির মত। সেগুলো কারওয়ান বাজারে বিক্রি করে পেয়েছি ৯শ’ টাকা। তা দিয়েই সবার দুই দিনের খাবার খরচ হয়েছে। আজকে সারাদিনে একবেলা খেতে পেরেছি। এইটা (ড্যান্ডি) খেলে ক্ষুধা লাগে না, তাই খাই।

রাজধানীর শাহবাগ, গুলিস্তান, গেন্ডারিয়া, কারওয়ান বাজার, বাংলামোটর, জুরাইন, হাতিরঝিলসহ বিভিন্ন রাস্তায় মাদকাসক্ত এসব পথশিশুদের চোখে পড়ে অহরহ। পথশিশুরা সাধারণত গাঁজা, ড্যান্ডি, পলিথিনের মধ্যে গামবেল্ডিং দিয়ে ও পেট্রোল শুঁকে নেশা করে। প্রকাশ্যেই তারা নেশা করে। আইনশৃঙ্খা রক্ষাকারী বাহিনী কিংবা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরও এসব মাদকাসক্ত শিশুদের বিষয়ে দেখেও না দেখার ভান করে চলে। গত কয়েক বছর ধরে মাদকাসক্ত শিশুদের মধ্যে ড্যান্ডির ব্যাপক ব্যবহার বেড়েছে বলে সরেজমিনে দেখা যায়।

জানা গেছে, সলিউশন নামে পরিচিত ড্যান্ডি মূলত একধরনের আঠা। এটি জুতা তৈরি ও রিকশার টায়ার টিউব লাগানোর কাজে ব্যবহৃত হয়। ড্যান্ডি খেলে ক্ষুধা ও ব্যথা লাগে না। দীর্ঘ সময় ধরে এটি খেলে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে কিডনি ও যকৃত। মস্তিস্কে বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা আছে।

কেন্দ্রীয় নিরাময় কেন্দ্রের সাবেক প্রধান পরামর্শক সৈয়দ ইমামুল হোসেন বলেন, মাদক শিশুদের মস্তিস্কের বিকাশ বাধাগ্রস্ত করে। চিকিৎসা দিয়ে তাদের সুস্থ করে তোলা সম্ভব। কিন্তু সুস্থ হওয়ার পর তাদের জন্য পুর্নবাসনের ব্যবস্থা করাটা খুবই জরুরি। তা না হলে তারা পুনরায় মাদক গ্রহণ করবে।

দেশে পথশিশু কিংবা মাদকাসক্ত শিশুর সংখ্যা কত এ নিয়ে আছে ভিন্ন ভিন্ন পরিসংখ্যান। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ আদমশুমারি প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, দেশে প্রায় চার লাখ পথশিশু রয়েছে। যার অর্ধেকই রাজধানীতে বসবাস করে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ২০১৬ সালে এক পরিসংখ্যানে উল্লেখ করে দেশে মোট মাদকাসক্তের ১০ শতাংশ শিশু।

বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য মতে, পথশিশুদের ৮৫ শতাংশই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মাদকে আসক্ত। রাজধানীর কমপক্ষে ২২৯টি স্পট রয়েছে যেখানে এসব শিশুরা নেশা করে। এদের বয়স ৯ থেকে ১৮ বছর। 

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সোশ্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক এনহ্যান্সমেন্ট প্রোগ্রাম (সিপ) ২০১৬ সালে তাদের এক গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, পথশিশুদের প্রায় ৪৪ শতাংশ মাদকাসক্ত। 

মাদকাসক্ত পথশিশুদের নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে ‘বিদ্যানন্দ’ নামে একটি বেসরকারি সংগঠন। ‘এক টাকার চিকিৎসা’ নামে একটি প্রকল্পের আওতায় তারা পথশিশুদের চিকিৎসা, শিক্ষা ও কাউন্সিলিং দিচ্ছে। 

প্রকল্পের সমন্বয়ক ডা.আসমা আক্তার জানান, অভিবাবকহীন এসব পথশিশুরা দুই বেলাও ঠিকভাবে খাবার খেতে পারে না। ক্ষুদা তাড়াতে তারা ড্যান্ডির মতো মাদক গ্রহণ করছে। ডেইলী বাংলাদেশ।