ফেসবুকে চলছে ধর্ষণ মনোভাবের খোলাখুলি চর্চা

এমডি কাওসার আহমদ:

দেশজুড়ে চলছে ধর্ষণ বিরোধী ক্যাম্পেইন। এ ক্যাম্পেইনে সাড়া দিয়েছে দেশের সব পেশার মানুষ। এ বাস্তবতার আড়ালে ফেসবুকে চলছে ধর্ষণের মনস্তাত্ত্বিক লালন। নানা গ্রুপে ধর্ষণ মনোভাব নিয়ে হচ্ছে খোলাখুলি চর্চা। এতে জড়িতদের বেশির ভাগই তরুণ। আর তাদের সঙ্গে খারাপ আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করতে সুর মেলাচ্ছে প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষও। সংশ্লিষ্টদের মতে, মামলার দীর্ঘসূত্রিতা, নারীদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের অভাবসহ নানা কারণ থেকে বাজে মন্তব্য করে পুরুষরা। এদিকে এসব অপরাধ রুখতে ব্যবস্থাও নিচ্ছে পুলিশ।

সম্প্রতি এইচএসসি পরীক্ষা না নেয়ার সিদ্ধান্তের বিষয়টি পুনর্বিবেচনায় নিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বিভাগের সচিব, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক ও ৯টি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানকে বিবাদী করে আইনি নোটিশ পাঠান এবারের এইচএসসি পরীক্ষার্থী শতাব্দি রায়। সঠিক প্রতিত্তোর না পেলে তিনি রিটের কথাও জানান। এতেই শতাব্দিকে ধর্ষণসহ তার বিরুদ্ধে নানা কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য ফেসবুক গ্রুপে আলোচনা করছেন এবারের এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছেলেরা। ফলে ওই পরীক্ষার্থী সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়েছেন।

শুধু এ ঘটনাই নয়, ফেসবুকে অনেক প্রাইভেট গ্রুপে পুরুষের কথাবার্তায় ফুটে উঠে নারীদের ধর্ষণ করার মনোভাব। আর এতে খোলামেলা নোংরা ভাষায় মন্তব্য করেন প্রাপ্ত বয়স্ক অনেক পুরুষও।

মনোচিকিৎসকের মতে, পারিবারিক শিক্ষা থেকে নারীর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের অভাবসহ নানা কারণে অনলাইন, ফেসবুকসহ সরাসরি নারীকে উদ্দেশ্য করে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করে বিকৃত মানসিকতার পুরুষরা।

মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মো. আকবর হোসাইন বলেন, দেশে হঠাৎ করে ধর্ষণের মাত্রা বা মনোভাব বেড়ে গেছে তা বলা ঠিক হবে না। যেকোনো দেশে হঠাৎ ধর্ষকের সংখ্যা বাড়ে না। একজন ধর্ষক সৃষ্টিতে অনেক বিষয় কাজ করে। পারিবারিক নৈতিক মূল্যবোধের শিক্ষার অভাব থেকে নারীর প্রতি অসম্মানজনক মনোভাব সৃষ্টি হয়।

তিনি বলেন, আমাদের দেশে রাজপথের পাশাপাশি অনলাইন বা ফেসবুকে ধর্ষণ বিরোধী প্রতিবাদ চলছে। এ প্রতিবাদ কর্মসূচিগুলো কতটুকু কার্যকর এটাই এখন বড় প্রশ্ন। এতো প্রতিবাদের মধ্যেও পত্রিকার পাতায় ধর্ষণের খবর কিন্তু কমছে না। পুরুষের ধর্ষণের মানসিকতার জন্মরোধ করতে পরিবারের কর্তব্য হচ্ছে যে, ছেলেদের নারীর প্রতি সম্মান করা শেখাতে হবে। পাশাপাশি একজন নারীকে নিরাপদ পরিবেশ ও বিশ্বস্ত সঙ্গী চিনতে পারার সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। বিপদজনক মুহূর্তে নিজেকে রক্ষা করার সব ধরনের প্রাথমিক পদক্ষেপ নেয়ার প্রক্রিয়াও নারীকে জানতে হবে।

আইন বিশেষজ্ঞের মতে, ফেসবুকে নারীকে ধর্ষণের হুমকি, নারীর ফেসবুক টাইমলাইন বা পোস্টের কমেন্টে অশ্লীল ছবি দেয়া, কোনো নারীকে উদ্দেশ্যে করে গ্রুপে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য অথবা আলোচনা করা (সাইবার বুলিং) দণ্ডবিধি অপরাধে পড়ে। অভিযোগ করা হলে এসব অপরাধে প্রাপ্ত বয়স্করা বিভিন্ন মেয়াদে সাজা ভোগ করবেন। আর একই অপরাধে অপ্রাপ্ত বয়স্কদের সংশোধাগারে পাঠানো হবে।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার এম এম জি সারওয়ার বলেন, ফেসবুকে নারীকে ধর্ষণের হুমকি, নারীর ফেসবুক টাইমলাইন বা পোস্টের কমেন্টে অশ্লীল ছবি দেয়া, কোনো নারীকে উদ্দেশ্যে করে গ্রুপে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য অথবা আলোচনা করা দণ্ডবিধি অপরাধের আওতাভুক্ত।

তিনি আরো বলেন, যারা অনলাইনে কোনো নারীকে হেনস্তা, অপদস্ত করার উদ্দেশ্যে ধর্ষণের হুমকি বা এ জাতীয় কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করবেন তা মানহানি অথবা সম্মানহানি অপরাধের (ডেফেইম অ্যালেজেইশনের) আওতায় পড়ে। অপরাধ প্রমাণিত হলে অপরাধীকে দণ্ডবিধি আইনে সাজা ভোগ করতে হবে। অনলাইন প্ল্যাটফর্মে হেনস্তা করার উদ্দেশ্যে কোনো নারীর টাইমলাইন বা কমেন্ট বক্সে অশ্লীল ছবি পোস্ট করলে পোস্টদাতা পর্নোগ্রাফি অ্যাক্ট-এ অপরাধী হিসেবে বিবেচিত হবেন। এতে অপরাধীর সাত বছরের সাজা হতে পারে।
 
ব্যারিস্টার এম এম জি সারওয়ার বলেন, ফেসবুকে নারীদের কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য বা আলোচনা করলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের (Digital Security Act) ৬, ৭,৮ ও ১৩ ধারায় শাস্তি পাবেন। অপরাধ প্রমাণিত হলেই তিন বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড হতে পারে।

ফেসবুকের নানা গ্রুপে নারীদের নিয়ে কুরুচিপূর্ণ আলোচনা বা মন্তব্য করে ১৮ বছরের কম বয়সীরা। তারা ফেসবুক গ্রুপে যৌনতা কেন্দ্রিক অশ্লীল কথাবার্তা বিনিময় করে। এদের ব্যাপারে এম এম জি সারওয়ার বলেন, অপরাধ প্রমাণিত হলে শিশু আইনে শিশু আদালতের মাধ্যমে ১৮ বছরের কম বয়সীদের সংশোধনাগারে দুই থেকে ছয় বছর রাখা হতে পারে। এ সময় তাদের মনোচিকিৎসক দ্বারা কাউন্সিলিং করা হবে।

তিনি বলেন, কোনো শিশুর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে। তাকে আটকের পর তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ক্রস চেক করতে হয়। তদন্তে প্রমাণ পেলে অভিযুক্ত শিশুকে শিশু আইনে শিশু আদালতে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।

ব্যারিস্টার এম এম জি সারওয়ার বলেন, অনেকে ভয় পেয়ে কিংবা না জেনে আইন প্রতিকার নিতে আসেন না। অনেক সচেতন ভুক্তভোগী মামলার দীর্ঘসূত্রিতার কারণেও আইনি প্রতিকার পেতে এগিয়ে আসেন না।

ফেসবুকে নারী বিষয়ক নানা ইস্যুতে নারীদের প্রতি বিকৃত মানসিকতার পুরুষের কুরুচিপূর্ণ বা বাজে মন্তব্যের বিষয়টি পুলিশের নজরে এসেছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) উপ-কমিশনার (মিডিয়া) ওয়ালিদ হোসেন।

তিনি বলেন, ফেসবুকে গঠনমূলক আলোচনা বা মন্তব্য করা যেতে পারে। তবে যেকোনো খারাপ কমেন্টস করা গ্রহণযোগ্য নয়। ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন অনুযায়ী এগুলো অপরাধ। কিছু কিছু বাজে মন্তব্য আমাদের নজরে পড়েছে। এ নিয়ে কাজ করছি। আমাদের নজরে বিষয়গুলো আরো আসবে। এ ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা নেব। সূত্র: ডেইলী বাংলাদেশ

এম২৪নিউজ/আখতার