করোনাকালের করুণ কাহিনি

 নূরুল ইসলাম বরিন্দী:

এক. তিন মাস ধরে স্বেচ্ছাবন্দি অবস্থায় দুর্বহ আর দুঃসহ সময় কাটছে বাসায় বসে বসে। বাসা থেকে মুহূর্তের জন্যও বাইরে বের হতে দেয় না পরিজনরা। বয়স্ক লোকদের বিশেষ করে যাদের হার্টের প্রবলেম, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, কিডনির সমস্যা রয়েছে তাদের নাকি করোনাভাইরাস সংকমণের সম্ভাবনা প্রবল। রাস্তা পার হলেই দুই মেয়ের বাসা। অথচ দেখা-সাক্ষাৎ হয় না কতদিন! ভালোমন্দ সংবাদ আদান-প্রদান হয় মোবাইলের মাধ্যমে। অন্যদের সংস্পর্শের ভয়ে ছাদেও যাওয়া হয় না। শরীর আর মনটাকে সতেজ রাখার জন্য মাঝে মাঝে কিছু প্রাণায়াম, হাটাহাঁটি, অ্যারোবিক, যোগব্যায়াম করি। আমার বাসার অবস্থানটা এমনই যে, সর্বক্ষণ আকাশ থাকে দৃষ্টিসীমার বাইরে। দুই ফ্লাটবাড়ির মাঝের ফাঁক দিয়ে যতটুকু বাতাস আসে তাও হারিয়ে যায় মাঝপথে। আলো থেকে ভিটামিন-ডি আহরণেরও উপায় নেই,–বলা যায় অসূর্যম্পশ্যা হয়ে আছি। এমতাবস্থায় একটা গানের কলি বারবার করে মনে পড়ে যায়ঃ “বন্দি পাখির মতো মনটা কেঁদে মরে/ মুক্ত আকাশখানি কে আমার নিল কেড়ে/ও আকাশ ও বাতাস বলে দাও কী নিয়ে থাকি/এ ব্যথা কী দিয়ে  বেঁধে রাখি”———

দুই. আহা! কী মর্মন্তুদ দৃশ্য! অনেকের হয়তো চোখে পড়ে থাকবে। ভারতের বিহারের মুজফফরপুর রেলস্টেশনের প্লাটফরমে নিথর হয়ে পড়ে আছে এক মায়ের মৃতদেহ। আর অবোধ শিশুসন্তানটি তার মায়ের মরদেহের ওপর জড়ানো কাপড় টেনে টেনে জাগাবার চেষ্টা করছে। ব্যর্থ হয়ে পরক্ষণেই মাকে ঢেকে দিচ্ছে সেই কাপড় দিয়ে। সে মনে করছে তার মা ঘুমিয়ে আছে। একটু পরই হয়তো জেগে উঠে তাকে কোলে তুলে নেবে। অথচ এই অবুঝ শিশু জানে না তার জন্মদাত্রী মা আর বেঁচে নেই, অনেকক্ষণ আগেই এ দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন না-ফেরার দেশে!

মৃত মহিলা বিহারের একটি মৌসুমি শ্রমিক পরিবারের সদস্য। কর্মস্থল গুজরাট থেকে ফিরছিলেন সরকারের ব্যবস্থাপনায় চালিত শ্রমিক স্পেশাল ট্রেনে করে। ট্রেন স্টেশনে পৌঁছুবার আগেই প্রচন্ড গরম আর ক্ষুধা-তৃষ্ণায় আসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। বিভিন্ন সোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া ভিডিও ক্লিপটি প্রকাশ হয় গত ২৫ মে, সোমবার।

অন্য আরেকটি সর্বত্র আলোচিত ঘটনার কথা বলি। এটিও ভারতের। লকডাউনের দুর্ভোগ থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য অসুস্থ রিকশাচালক বাবাকে বাই-সাইকেলের ক্যারিয়ারে বসিয়ে ১৫ বছরের কিশোরী জ্যোতি কুমারী হরিয়ানার গুরুগ্রাম থেকে টানা ৭ দিন সাইকেল চালিয়ে ১ হাজার ২শ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে বিহারের নিজ বাড়িতে পৌঁছলে খবরটি ভাইরাল হয় সামাজিক মাধ্যমে। অদম্য মনোবল আর দুঃসাহসিক মনোভাবের বিস্ময়কন্যা হিসাবে সর্বত্র প্রশংসিত ও আলোচিত হয় এই কিশোরী। তার প্রতি ভালোবাসা আর লড়াকু মানসিকতার জন্য মার্কিন মুলুকের অধিপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের মেয়ে ইভাংকা ট্রাম্প টুইট করে স্যালুট জানিয়েছেন এই ১৫ বছরের কিশোরী জ্যোতি কুমারীকে।

বুঝতেই পারছেন, উপরে উল্লেখিত ঘটনাগুলোর সবই প্রাণঘাতি রোগ করোনাভাইরাসের নেপথ্য পটভূমি। এখন আসা যাক সৃষ্টির সর্বশ্রেষ্ঠ জীব মানবকুল—আশরাফুল মাখলুকাতের উপর ভয়াবহ গর্দিশ কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাস প্রসংগে।

সকলেরই মনে থাকার কথা, গত ৩১ ডিসেম্বর/২০১৯-এ করোনাভাইরাসের প্রথম সংক্রমণ ঘটে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরের একটি  বাজার থেকে। গবেষকদের প্রাথমিক ধারণা ছিল রোগটির উৎপত্তি বাদুড়, সাপ কিংবা পাংগুলিন থেকে। এই বাজারে নাকি বিক্রি হতো ওইসবের মাংস। আর তা থেকেই এই ভয়ংকর প্রাণঘাতি ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে চীন সাম্রাজ্যের সর্বত্র। আক্রান্ত হতে থাকে হাজার হাজার মানুষ। গোটা চীন পরিণত হয় মৃত্যু উপত্যকায়! এর পরের ইতিহাস তো সকলেরই জানা। চীনে কয়েক হাজার মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়ে, মহাচীনের গ্রেটওয়াল ডিংগিয়ে, চারদিক  লন্ডভন্ড করে দিয়ে দুই শতাধিক ছোট-বড় দেশের লাখ লাখ মানুষের জীবন কেড়ে নিতে থাকে এই নিষ্ঠুর-নির্মম করোনাভাইরাস!  এখনও অব্যাহত রয়েছে তার মরণ কামড়! একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে সীমাবদ্ধ নেই এর অবস্থান। মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা—কোনো বাছবিচার নেই, সর্বব্যাপী এর বিধ্বংসী উপস্থিতি। আর কিছু নয়, মানুষের প্রাণসংহারই এর একমাত্র দক্ষযজ্ঞ।

তিন. তবে, বিশ্বে এ যাবৎকাল সংঘটিত মহামারি আর ভাইরাস প্রাদুর্ভাবের ইতিহাস এটাই নতুন নয়। প্রাগৈতিহাসিক যুগের কথা না-হয় বাদই দেওয়া গেল। ৫৪১ সালে মিশরে উৎপত্তি হয়ে যে মহামারি ভাইরাসটি তৎকালীন কন্সটান্টিনোপলে পৌঁছেছিল, সম্রাট জাস্টিনিয়ানের নামানুসারে তার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘জাস্টিনিয়ান প্লেগ’। পরে ইউরোপ, এশিয়া, উত্তর আমেরিকাসহ গোটা মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে পড়ে এ রোগ। এর মূল বাহক ছিল ইঁদুর। এ রোগে প্রায় ৫ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়। তখন একে প্রতিরোধ করার প্রাথমিক উপায় হিসাবে বেছে নেওয়া হয় আক্রান্তদের এড়িয়ে চলা। এতে করে রোগের প্রকোপ অনেকটা কমে আসে।

জাস্টিনিয়ান প্লেগের ৮শ বছর পর ১৩৪৭ সালে ‘ব্লাক ডেথ’ নামে এক মরণঘাতি রোগ আঘাত হানে ইউরোপের মাটিতে। ৪ বছরব্যাপী স্থায়ী সেই সর্বনাশা রোগে মৃত্যুবরণ করে ২০ কোটি মানুষ। এই রোগের সময়কালেই কোয়ারেন্টিন ধারণার উদ্ভব ঘটে।

এরপর প্রায় ৩শ বছর ধরে মহামারির আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয় ইংল্যান্ড। ১৬৬৫ সালে মাত্র ৭ মাসে লন্ডনে প্রায় ১ লাখ বাসিন্দা প্রাণ হারায় ‘দি গ্রেট প্লেগ অব লন্ডন’ নামের এই রোগে। এ রোগের প্রকোপ ঠেকাতে ‘লকডাউন’ বা ঘরবন্দি থাকার রেওয়াজ চালু হয়।

ইউরোপ, এশিয়া ও আরব অঞ্চলের প্রাণঘাতি রোগ ছিল ‘গুটি বসন্ত’। মেক্সিকো ও আমেরিকায় এ গুটি বসন্ত আবির্ভূত হয়েছিল মহা আতংকরূপে। আক্রান্ত হয়েছিল ১ কোটি ৫০ লাখ মানুষ। মৃত্যুবরণ করে ২০ লাখ। এর পরের দশকে একটি কার্যকর ভ্যাক্সিন আবিষ্কারের মধ্যদিয়ে এ দুর্যোগের অবসান ঘটে। ১৯৮০ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিশ্বকে গুটি বসন্তমুক্ত ঘোষণা করে।

কলেরা এক সময় মানবজাতির জন্য ছিল মহা-আতংক। এর উৎপত্তি ঘটেছিল রাশিয়ায়, ১৮১৭ সালে। এতে প্রাণহানি হয়েছিল ১০ লাখ মানুষের। সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছিল এই রোগ। ওই সময় ২২/২৩ লাখ মানুষ মারা যায়। জন স্নো নামের এক রোগতত্ত্ববিদ এ রোগের প্রতিষেধক আবিষ্কার করলে পৃথিবীবাসী মানুষেরা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। (তথ্যসূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো)।

চার. আবার আসা যাক বর্তমান করোনাভাইরাস প্রসংগে।  বিশ্বে ইতিপূর্বেকার সংঘটিত মহামারিগুলোর  ধ্বংসলীলার তুলনামূলক বিচারে কোভিড-১৯ -এ মৃত্যুর হার কম মনে হলেও (আপাতত) এর আচার-আচরণ, মেজাজ-মর্জি , ছড়িয়ে পড়ার অভিনবত্ব একেবারেই ভিন্ন। এর কাছে ধনী-নির্ধন, রাজা-রাজাধিরাজ কোনো বাছবিচার নেই। সুযোগ পেলেই মানুষের নাক দিয়ে, মুখ দিয়ে, চোখ দিয়ে ঢুকে ফুসফুসে তার অব্যর্থ ক্রিয়া-কলাপ শুরু করে দেয়। পরিণামে অনিবার্য মৃত্যু ঘটে মানুষের! এর এমনই মারাত্মক সর্বব্যাপী প্রভাব যে, মানুষ একজন আরেকজনের কাছে যেতে পারে না। আক্রান্ত সন্দেহে মাকে ফেলে আসা হয় নির্জন প্রান্তরে। হাসপাতালে মৃত্যু হলে পালিয়ে যায় সজনরা, আক্রান্ত ব্যক্তি হয়ে যান বেওয়ারিশ লাশ! সন্তান তার জনকের দাফন-কাফন করতে অনীহা প্রকাশ করে। মুসলমানকে কবরস্থ করেন মাত্র চার সেবাদানকারী ব্যক্তি! হিন্দুর মরদেহ সৎকারের অনুমতি দিতে শ্মশান কর্তৃপক্ষের অনীহা –এমন ঘটনাও প্রত্যক্ষ করেছি এবং করছি আমরা!

পাঁচ. অকাল বৈশাখের এলোকেশি ঝড়ের চাইতেও তীব্র গতিসম্পন্ন এই করোনাভাইরাস আকাশচারী বাহকের মাধ্যমে মাত্র ২৪ ঘন্টার কম সময়ের মধ্যে বেইজিং থেকে লন্ডনের হিথ্রো কিংবা নিউইয়র্ক অথবা রোমে পৌঁছতে পারে। এর প্রমাণ আমরা ইতিমধ্যেই প্রত্যক্ষ করেছি। ৩১ ডিসেম্বর/২০ ১৯-এ উহান শহর থেকে ঝটিকার বেগে সারা মহাচীনে ছড়িয়ে পড়ে কয়েক হাজার চৈনিকের প্রাণ সংহার করে গ্রেটওয়াল ডিংগিয়ে করোনা এখনও তার ভয়াল থাবা হানছে এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ, দুই আমেরিকার দেশে দেশে। ব্রাজিল, ইটালি, স্পেনের গণকবরে হাজার হাজার কফিনের উপর মাটি চাপা দেওয়ার দৃশ্য আমরা প্রতিদিন প্রত্যক্ষ করছি টিভির পর্দায়।   লন্ডনের ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে বৃটেনের প্রধানমন্ত্রীকে কোয়ারেন্টিনে  ঢুকিয়ে ওই ঝড়ের বেগেই করোনা যখন হামলে পড়লো বিশ্বের ১ নম্বর ক্ষমতাধর দেশ আমেরিকার প্রাণকেন্দ্র নিউইয়র্ক সিটিসহ বিভিন্ন অংগ রাজ্যে, তখন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পেন্টাগন কিংবা হোয়াইট হাউজে বসে অসহায়ের মতো চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া করার আর কিছুই থাকছে না। ক্রুজ, মিসাইল, পারমাণবিক অস্ত্র কিছুই কাজে লাগছে না। পাল্টা আঘাত হানবেন কোথায়? এতো আর বিন লাদেন না। অদৃশ্য ঘাতক শত্রু করোনাভাইসাসকে চোখে দেখা গেলে তো? এ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে ভাইরাসের সংক্রমণে মৃতের সংখ্যা ছাড়িয়েছে লাখের উপরে, গোটা দুনিয়ায় সংখ্যার দিক দিয়ে ১ নম্বরে! 

প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের আমলে, ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ও পেন্টাগনে হামলা চালিয়ে ৩ হাজার মানুষকে হত্যা করে আমেরিকার গর্বোদ্ধত মস্তককে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিয়েছিল যে আল কায়দা নেতা ওসামা বিন লাদেন, তার মাথার দাম ঘোষণা করা হয়েছিল আড়াই কোটি মার্কিন ডলার  (অবশ্য ঘটনার প্রায় এক দশক পর ২০১১ সালের ২ মে, বারাক ওবামার আমলে পাকিস্তানে পালিয়ে থাকা ওসামা বিন লাদেনকে মার্কিন গোয়েন্দার “ইউএস নেভিগেশন সিল”-এর কমান্ডোরা এবোটাবাদের একটি গোপন আস্তানায় হানা দিয়ে হত্যা করে রাতের অন্ধকারে তার লাশ আরব সাগরে ভাসিয়ে দেয়)। আজ সেই মহাশক্তিধর মার্কিন মুলুকে অদৃশ্য করোনাভাইরাস মহাদাপটের সাথে নির্বিবাদে একের পর এক লাশ ফেলছে শহর, বন্দর, জনপদে। চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করার থাকছে না বিশ্ব-মোড়লের।

ওদিকে অ্যাঞ্জেলা মার্কেলকে একটুখানি ঝাঁকুনি দিয়ে করোনা তার ভয়াল রূপ নিয়ে হাজির হয়েছে রাশিয়ায়, একটু দেরিতে। মস্কোর ঘন্টায় মহাবিপদের বার্তা দিয়ে কোভিড -১৯ যখন ঢং ঢং শব্দ তুলে রাশিয়ার ঘরে ঘরে হানা দিয়ে একের পর এক লাশ ফেলছে, ভ্লাদিমির পুতিন তখন লেনিনগ্রাদের অভ্যন্তরে বসে ৩৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় টিকে থাকার প্লান-প্রোগ্রাম নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। সম্ভবত এখন তারও লকডাউন বা কোয়ারেন্টিনে থাকার অবস্থা! ওদিকে দূরপ্রাচ্যের সম্পদ-সমৃদ্ধ  দেশ জাপান আর  বিশ্বের মুসলিম  সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ   ইন্দোনেশিয়ায় অতটা সংহারমূর্তি ধারণ না করলেও একেবারে ছাড় দেয়নি করোনা।

ছয়. করোনাভাইরাসের বৈশ্বিক এই মহাদুর্যোগেও কিন্তু বন্ধ নেই দেশে দেশে রাজনীতি, অর্থনীতি, কূটনীতি, সমরনীতি, দমননীতি, দুর্নীতিসহ নানামুখী তৎপরতা। থেমে যায়নি সিরিয়ার আকাশে যুদ্ধবিমানের গর্জন, ইরাকে আইএসের জিহাদী তৎপরতা, আফগানিস্তানে তালেবানী হামলা, ইয়েমেনে হুতি বিদ্রোহ, ভারতের লাদাখ সীমান্তরেখা বরাবর চীনের সৈন্য সমাবেশ ও বিমানঘাঁটি স্থাপনের অশুভ পাঁয়তারা, স্নায়ুযুদ্ধের জের ধরে চীনকে মার্কিন প্রেসিডেন্টের প্রতিশোধের হুমকি, জাপান সাগরে কিম ইল জং-এর মিসাইল পরীক্ষার মতো পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টিকারী কার্যকলাপসহ আরও অনেক নেতিবাচক ঘটনা। এর সাথে নতুন করে যুক্ত হয়েছে সম্প্রতি লিবিয়ায় মানব পাচারকারী চক্রের হাতে ২৬জন নিরীহ বাংলাদেশি নিহত হওয়ার ঘটনা, আমেরিকায় শ্বেতাংগ পুলিশের পায়ের চাপায় কৃষ্ণাংগ নাগরিকের করুণ মৃত্যু। প্রতিবাদে ফুঁসে উঠেছে কৃষ্ণাংগ জনতা। রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে বিক্ষুব্ধ জনতার রোষ থেকে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে সম্ভাব্য বিপদ থেকে  নিরাপত্তার জন্য তাৎক্ষণিকভাবে সরিয়ে নিতে হয়েছে  একটি বাংকারে। এখনো চলমান রয়েছে প্রতিবাদ আন্দোলন। ২৩টি অংগরাজ্যে নিরাপত্তারক্ষী মোতায়েন, ৪১টি রাজ্যে কারফিউ জারি করে বিক্ষোভ দমাতে সেনা নামাবার হুমকি দিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এই রকম টালমাটাল পরিস্থিতিতে করোনায় মৃতের সংখ্যা আরও বাড়ার আশংকা দেখা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে।

করোনাকালের জের ধরে বিশ্ববাসীর জন্য আরেকটি দুঃখজনক খবর হলো, করোনার বিস্তার রোধে ব্যর্থতার অভিযোগ এনে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাথে সকল প্রকার সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা  (সংস্থাটির ৪০% আর্থিক যোগানদাতা আমেরিকা)। এ সবই হচ্ছে করোনাকালের নেতিবাচক দিক। তবে সামান্য কিছু ইতিবাচক দিক থাকলেও তা উল্লেখ করার মতো নয়।

সাত. এবারে আসা যাক করোনাক্রান্ত বাংলাদেশ প্রসংগে। বিশ্ব স্বাস্থ্য  সংস্থা গত ৩০ জানুয়ারি করোনাভাইরাসকে সর্বোচ্চ স্বাস্থ্য ঝুঁকি এবং ১১ ফেব্রুয়ারি বৈশ্বিক মহামারি ঘোষণা করে। আর বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রথম শনাক্ত হয় ৮ মার্চ। সেই থেকে করোনাভাইরাস শনাক্তের বৈশ্বিক হারের সাথে পাল্লা দিয়ে আমাদেরও জ্যামিতিক হারে বাড়ছে শনাক্ত এবং মৃতের হার। এরই জের হিসাবে লকডাউন, কোয়ারেন্টাইন, আইসোলেশন, সরকারি- বেসরকারি অফিস, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কল-কারখানা, গণপরিবহনসহ সবকিছুতে অচলাবস্থার মধ্যদিয়ে দুঃসহ সময় অতিবাহিত করেছে বাংলাদেশের মানুষ। তার ওপর ছিল প্রাকৃতিক দুর্যোগ ‘আম্ফানে’র ধাক্কা। এরই মধ্যে চলে গেছে অনানুষ্ঠানিকভাবে বাংগালির ১লা বৈশাখের পার্বন, নিরানন্দময় ইদুল ফিতর। আমদানি-রপ্তানি, ব্যবসা-বাণিজ্য, গার্মেন্ট শিল্পে ধস নামার আশংকা, অর্ডার বাতিল হবার ভয়, দেশি-প্রবাসী শ্রমিক ছাঁটাই, রেমিটেন্সপ্রাপ্তির অংকের হারে ক্রমশ নিম্নগতি –এইসব শংকা-সংকটের বোঝা ঘাড়ে নিয়ে  বিশ্বায়নের এই যুগে, অর্থনীতির সব চাকা বন্ধ রেখে কতদিন চলতে পারে উন্নয়নশীল একটা দেশ! এমনিতেই বিশ্বের ধনী দেশগুলো পর্যন্ত করোনা-কারণে  অর্থনৈতিক ধসের শিকারে বিপর্যস্ত। অনুন্নত ও উন্নয়নশীল গরিব দেশগুলোর অবস্থা তো আরও করুণ! করোনাভাইরাস সংক্রমিত বহু দেশে লকডাউন যেমন শিথিল করা হচ্ছে আবার নতুন করে লকডাউন আরোপও করা হচ্ছে, তেমনি লকডাউন তুলে নেওয়ার জন্য মানুষের বিক্ষোভ মিছিলও প্রত্যক্ষ করছি আমরা টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে।

আট. আমাদের দেশে সীমিত ক্ষেত্রে কিছু কিছু বিধিনিষেধ বহাল রেখে ১ জুন থেকে খুলে দেওয়া হয়েছে সবকিছু। দীর্ঘ ৬৬ দিন পর লকডাউনমুক্ত হয়ে জীবন-জীবিকার তাগিদে মানুষ ছুটছে নিজ নিজ কর্মস্থলে, কাজের সন্ধানে। একদিকে পেটের ক্ষুধা নিবারণ, বেঁচে থাকার উপায় অন্বেষণ, অপরদিকে প্রাণঘাতি করোনাভাইরাসের ছোবলে মৃত্যুর ক্রমশ দীর্ঘতর মিছিল—এ সবই জীবনের অনিবার্য পরিণতি! এ উভয় সংকটকে সাথে নিয়েই চলতে হবে আমাদের। এটাই নিয়তির পরিহাস! এ মুহূর্তে, করোনা পরিস্থিতি মাথায় রেখে, সবদিক সামাল দিয়ে সরকারকে যেমন সামনের দিকে পা ফেলতে হবে, তেমনি দেশের নাগরিক সাধারণকেও কঠোরভাবে স্বাস্থ্যনীতি, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। বিশেষ করে ৩ ফুটের সামাজিক দূরত্ব বজায়, মুখে মাস্ক পরা ও ২০ সেকেন্ড ধরে হাত ধোয়া—প্রতিষেধক না আসা পর্যন্ত আপাত সংক্রমণ ঠেকাবার এই তিনটি উপায়কে জীবনের নিত্যসংগী করার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে।

আমরা বিশ্বাস করি,  ইতিহাসের অমোঘ নিয়মে মানুষের অমিত শক্তির কাছে এই খান্ডবরূপী করোনাভাইরাস পরাভূত হবেই একদিন না একদিন! তবে সেই সাথে আমাদের বিশ্বাস রাখতে হবে বিশ্বনিয়ন্তা করুণাময় মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের ওপর, যিনি যুগে যুগে তাঁর সৃষ্ট মানবজাতিকে তাদের পাপাচার আর অবাধ্যতা হেতু পানিতে ডুবিয়ে, আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করে, জমিন উল্টিয়ে দিয়ে, প্রবল ভূমিকম্পের মতো গজব নাজিল করে ধ্বংস করেছিলেন, যেমন– কওমে নুহ, কওমে লুত, আদ, সামুদ প্রভৃতি জাতি। হতে পারে এই করোনাভাইরাসও তেমনি একটি আসমানি গজব! আল্লাহ আলিমুল গাইব। সকল বিষয়ে তিনি অবগত। পবিত্র কোরআনের সুরা বাকারার ১১৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছেঃ “ নিশ্চয় আমি তোমাদের কিছু ভয় ও ক্ষুধা দ্বারা এবং কিছু ধন, প্রাণ ও ফসলের ক্ষতি দ্বারা পরীক্ষা করবো এবং তুমি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও”।

অবশ্যই আমরা ধৈর্যধারণ করবো । আল্লাহ আমাদের সহায় হোন!

নূরুল ইসলাম বরিন্দী, ই-মেইল: nibarindi@gmail.com