নূরুল ইসলাম বরিন্দী :
ইঞ্জিনের তীব্র আওয়াজ তুলে, দিক-বিদিক তোলপাড় করে ছুটে আসে জিপ, ট্রাক, লরি। পেটে, পিঠে, পাঁজরে যাত্রী বোঝাই বাস আসে একটার পর একটা। বাসস্টান্ডে থামে কিছুক্ষণের জন্য । তারপর আবার রাগী গোঁয়ারের মতো গজরাতে গজরাতে চলে যায় উত্তরের জেলা শহর অভিমুখে।
বাস ভর্তি মানুষের হৈ-হুল্লোড়, চিৎকার, -কলরব আর স্লোগানে স্লোগানে কিছুক্ষণের জন্য মুখরিত হয়ে ওঠে বাসস্টান্ড। রাস্তার দুপাশে, আশপাশের দোকানপাটে ভিড় জমে যায় কৌতূহলী মানুষের। ভারী মেশিনগানবাহী জিপ, বিশালকায় ট্যাংক আর মুক্তিযোদ্ধা ভর্তি ট্রাকগুলো মানুষের ভিড়ের মধ্যে এসে থামে কিছুক্ষণের জন্য। আর অমনি জনতা উল্লাসে ফেটে পড়ে। বিজয় উল্লাসে গাড়ির ওপর ধেই ধেই করে নাচে মুক্তিযোদ্ধারা। শূন্য আকাশের চারদিকে মুখ উঁচিয়ে তুলে ধরে এস এম জি, এল এম জি। দ্রিমদ্রিম, ঠা-ঠা-ঠা গুলি ছোড়ে বেপরোয়া। ধোঁয়া আর বারুদের গন্ধে ভারী হয়ে ওঠে আশপাশের বাতাস। রাস্তার দুপাশে অপেক্ষমাণ জনতা। তাদের মধ্যে থেকে কেউ কেউ এগিয়ে যায় সামনে। হাত মেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে। চারদিক মুখরিত হয়ে ওঠে “জয়বাংলা” ধ্বনিতে। এভাবে একের পর একটা দল আসে, চলে যায় আকাশ-বাতাস মথিত করে। আনন্দ-উদ্বেলিত জনতাও তাদের কণ্ঠের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে স্লোগান দেয়- – “জয়বাংলা”!—
এইভাবে, এ রকম দৃশ্যাবলির মাঝে সোনালী সকাল ক্রমশ উঠে যায় দুপুরের মগডালে। দুপুর গড়িয়ে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে আসে ঝিমধরা বিকেল। সেই বিকেলের আলোটুকুও মুছে যায় এক সময়। এরপর হামাগুড়ি দিয়ে নামে ডিসেম্বরের শীতার্ত সন্ধ্যা। রাস্তার লাইটপোস্টে জ্বলে ওঠে বৈদ্যুতিক বাতি। যানবাহন চলাচলে ভাটা পড়ে আসে ক্রমশ। গেঁয়ো কৌতূহলী মানুষগুলো যে যার বাড়ির পথ ধরলে থিতিয়ে আসে মিঠাপুকুর উপজেলা বাসস্টান্ড।
একটা ভাঙ্গা নড়বড়ে বেঞ্চের ওপর ঠায় বসে থাকেন তিনি। নির্জনতায় খা খা করে চারদিক। তার জীর্ণ বুকের তলদেশ থেকে উঠে আসে একটার পর একটা দীর্ঘশ্বাস। সন্ধ্যার হিমশীতল বাতাস হাহাকার ছড়ায় সেই চাপা দীর্ঘশ্বাসের আকুতিতে। তার পুরু লেন্সের চশমার কাচের ভেতরের যন্ত্রণাকাতর দৃষ্টিতে একটা গভীর হতাশা কিলবিল করে কেদো কেঁচোর মতো। তার বয়েসী মুখ আর কপালের বলিরেখাগুলো কুঞ্চিত হয়ে ওঠে আরো। নির্জন বাসস্টান্ডে উন্মত্তের মতো চারদিক থেকে নিস্তব্ধতা ধেয়ে আসে অন্ধকারকে সহযোগী করে। তিনি ঠায় বসেই থাকেন ভাঙ্গা বেঞ্চের ওপর।
ক্রাচে ভর দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে দু কিলোমিটার এবড়ো-খেবড়ো মেঠোপথ ভেঙ্গে সেই সাত-সকালে তিনি আসেন মিঠাপুকুর বাসস্টান্ডে। আজ নিয়ে তিন দিন। সকাল থেকে সন্ধ্যা অব্দি একনাগাড়ে বসে থাকেন। ঝাপসা দৃষ্টি মেলে দিয়ে মানুষের যাওয়া-আসা লক্ষ্য করেন। বাস-লরি-ট্রাক বোঝাই মানুষজন আসে-যায়। জান্তব চিৎকার, হৈ-হুল্লোড়ে সরগরম হয়ে ওঠে মিঠাপুকুরের ছোট্ট বাসস্টান্ড। তিনি কখনো চঞ্চল হয়ে ওঠেন উত্তেজনায়, কখনোবা ভেঙ্গে মিইয়ে চুপসে যান নিজের ভেতরে। মানুষের হাজারো মুখের ভিড়ে একটি চির পরিচিত মুখের সন্ধান করেন গভীর আগ্রহে!
দূরাগত মানুষজন যে যার গন্তব্যের উদ্দেশ্যে চলে গেলে তিনি হতাশায় মুষড়ে পড়েন। তিনি যে একজন বয়োবৃদ্ধ পঙ্গু মানুষ, বসে আছেন অতি প্রত্যাশিত একটি মুখের মানুষের অপেক্ষায়, সকাল থেকে সন্ধ্যা অব্দি, এ খবর পৃথিবীর কেউ-ই যেন জানে না। জানার প্রয়োজনও বোধ করে না। মাঝে মধ্যে চশমা খুলে কম্পিত হাতে পাঞ্জাবির খুঁটে ধোঁয়াটে কাচ পরিষ্কার করে নেন। আবার চোখে লাগান। অপেক্ষা করেন পরবর্তী গাড়িতে লোকজন আগমনের। এখানে, এই পথে তার আত্মজ ফিরে আসবে । যুদ্ধশেষের বিজয়ী সৈনিক হিসেবে । ফিরে আসবে পিতৃকোলে , স্বগ্রামে,স্বজনদের মাঝে। এ রকম প্রত্যয় আর আত্মবিশ্বাস নিয়ে তিনি পথের পানে চেয়ে থাকেন নিত্যদিনের নিত্যসময়। উত্তরের ঠান্ডা হাওয়া ধেয়ে আসে শোঁ শোঁ শব্দ তুলে। কোঁকড়ানো চামড়ার ওপর পরিপক্ব রোমকূপগুলো শির শির করতে থাকলে সর্বাঙ্গে গরম চাদর জড়িয়ে নেন তিনি। অনুভব করেন সন্ধ্যার তরল অন্ধকার কেটে এগিয়ে আসছে শীতার্ত রাত। নির্জন বাসস্টান্ড, লাইটপোস্টের আবছা আলো , দূরের কুয়াশাচ্ছন্ন আকাশ ঘোলাটে অন্ধকারে ক্রমশ ডুবে যেতে থাকলে তিনি নিজের মধ্যে আত্মগত হতে থাকেন কেবলই।
দূর-অতীত রোমন্থন করতে থাকেন নিজের মনে।—দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন আসামের ডিব্রুগড়ে। তখন যুবক বয়স। বাড়ি পালিয়ে চাকরি নিয়েছিলেন আসাম-বেঙ্গল রেলওয়েতে। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোসের আজাদ হিন্দ ফৌজ তখন বার্মা সীমান্ত অতিক্রম করে ঢুকে পড়েছে বৃটিশ-ভারতের ভেতরে। জাপানি জঙ্গী বিমানগুলো বোমা ফেলছে ইম্ফল, ডিব্রুগড়, কলকাতায়। চারদিকে শুধুই যুদ্ধাতংক। শেষ পর্যন্ত পালিয়ে এলেন নিজের বাড়িতে। যুদ্ধের ঘনঘটা শেষে এন্ট্রান্স পাস করে চাকরি নিলেন নিজের গ্রামের স্কুলে। বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিশ বছর পর আবার প্রত্যক্ষ করলেন উনিশ শ পঁয়ষট্টি সালের পাক-ভারত যুদ্ধ। তার পাঁচ বছর পর একাত্তরে, নিজের দেশের মাটিতে জীবনে তৃতীয়বারের মতো যুদ্ধের লণ্ডভণ্ড পরিস্থিতির শিকার হলেন তিনি।
মাত্র নয়টা মাস। এরই মধ্যে কতো কিছু ওলোট-পালোট, কতো কিছু পরিবর্তন ঘটে গেলো নিজের জীবনে। পাকিস্তানি হানাদারদের ভয়ে মানুষজন পালিয়ে গেলো নিরাপদ আশ্রয়ে, ভারতে। উজাড় হয়ে গেলো বাংলার গ্রাম-গঞ্জ। ধূসর বিবর্ণ হয়ে গেলো সোনালী ফসলের মাঠ-ময়দান। প্রায় নির্জন শ্মশানের রূপ ধারণ করলো লোকালয়ের পর লোকালয়। মাটি আঁকড়ে, বাপ-দাদার গেরস্থালি জাপ্টে ধরে সাহসে বুক বেঁধে পড়ে থাকলেন তিনি ভয়াবহ এই শ্মশানে! জীবনের ন্যূনতম নিরাপত্তাই যেখানে উধাও সেখানে পালিয়ে কোথায় যাবেন তিনি? এই যে বাসস্টান্ড, এই যে থানা শহর মিঠাপুকুর আজকের মতো সেদিন এমনি নির্ভয়ে, নিরাপদে এবং নিশ্চিন্তে ঘন্টার পর ঘন্টা কয়জন এসে বসতে পেরেছে এখানটায়? হায়রে সময়, হায়রে যুদ্ধ! ভাবতে গিয়ে বুকের পাঁজর ভেদ করে কয়েকটা গভীর দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে তার।
–“বাবা, আমি যুদ্ধে গেলাম, আমার জন্য ভাববেন না”—ছোট্ট একটা চিরকুটে কথা কয়টি লিখে রাতের অন্ধকারে হারিয়ে গেলো ছেলেটা। তার একমাত্র ছেলে মঞ্জু। তিনিও ভালোবাসেন দেশকে। দেশের মাটি ও মানুষকে। কিন্তু একমাত্র ছেলের বিনিময়ে দেশের স্বাধীনতা পাওয়ার বয়স আর মন-মানসিকতা ছিলো না তার। তবু এ আশায় বুক বেঁধে রইলেন যে, হয়তো ছেলে তার ফিরে আসবে একদিন। ফিরে আসবে যোদ্ধার বেশে, স্বাধীনতার লাল সূর্যটাকে হাতে নিয়ে। এ রকম চিন্তা আর আশা মনের ভেতরটায় উঁকিঝুঁকি দিলে গর্বে ফুলে-ফেপে উঠেছে তার বুকটা। একজন মুক্তিযোদ্ধার পিতৃগৌরবের অহংকার তাকে উদ্দীপ্ত, উজ্জীবিত করে তুলেছে প্রতিনিয়ত।
মির্জাপুরের নূরুদ্দিন মাস্টারের কলেজে পড়ুয়া জোয়ান ছেলে মুক্তি বাহিনীতে যোগ দিয়েছে এ খবর গ্রাম-গঞ্জ থেকে থানা সদর—সেখান থেকে জেলা সদরের মিলিটারি হেড কোয়ার্টারে পৌঁছতে সময় লাগেনি বেশি। জুনের শেষনাগাদ হঠাৎ করে মিলিটারিরা হানা দিলো মির্জাপুরে। দু-চারজন রাজাকার ছাড়া গ্রামের বাদ-বাকি লোক পালিয়ে গেলো প্রাণের ভয়ে। হানাদাররা উপস্থিত পেলো শুধু নূরুদ্দিন মাস্টারকে। দুজন পাঞ্জাবি তাকে পিচমোড়া করে বেঁধে ফেললো উঠানের আমগাছটার সঙ্গে। ছেলে যোগ দিয়েছে মুক্তি বাহিনীতে,সাহায্য করছে পাক-ওয়াতানের শ্ত্রুদের,–এরচেয়ে ভয়ংকর অপরাধ আর কী হতে পারে?
শুরু হলো অমানুষিক অত্যাচার। বেয়োনেটের আঘাতে আঘাতে আর্তচিৎকার করতে থাকলে বৃদ্ধ বাপের সাহায্যে পর্দার আড়াল থেকে মরিয়া হয়ে বেরিয়ে এসেছিলো বড় মেয়ে সালেহা। চোখের সামনে একটি যুবতী নারীকে দেখে তাকে ভোগের লালসায় উন্মত্ত হয়ে ওঠে ওরা। নূরুদ্দিন মাস্টারকে ছেড়ে হায়েনা তিনজন সালেহাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেলো একটা ঘরে। তারপর পাশবিকতার চূড়ান্ত করলো তিন সৈনিক মহা ফুর্তিতে। অনেকক্ষণ পর অচৈতন্য সালেহাকে ফেলে রেখে ওরা তিন বীর পুরুষ চলে যেতে যেতেও থমকে দাঁড়ালো উঠানের শেষ প্রান্তে গিয়ে । একজনের আগ্নেয়াস্ত্র স্থির হলো বৃদ্ধ বন্দি নূরুদ্দিন মাস্টারের দিকে। তারপর হিস্ স্–! একটামাত্র শব্দ। রক্তাক্ত বৃদ্ধের দেহটা ঢলে পড়লো আম গাছের গোড়ায়।!
কিন্তু তিনি বেঁচে রইলেন। তবে একটা পা হারালেন চিরদিনের জন্য। সেটা কেটে ফেলতে হয়েছে অপারেশনের সময়। আর মেয়ে সালেহা? রাতের অন্ধকারে একদিন যেমন করে একমাত্র ছেলে মঞ্জু পালিয়ে গিয়েছিলো যুদ্ধে,– তেমনি আরেকটি রাতের অন্ধকারে লোকলজ্জার ভয়ে ধর্ষণের দগদগে চিহ্ন সারা অঙ্গে ধারণ করে সালেহাও চলে গেলো বাড়ি ছেড়ে, গ্রাম ছেড়ে। জীবিত অথবা মৃত আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি তাকে। জীবনের সাথে বাজি রেখে ছেলে যুদ্ধে লড়ছে। সতীত্ব হারিয়ে মেয়ে নিখোঁজ। একটা পা হারিয়ে তিনিও পঙ্গু। এ রকম অনভিপ্রেত অথচ অবধারিত এ করুণ পরিণতির শিকার হয়ে বেঁচে রইলেন নূরুদ্দিন মাস্টার। আর কি-ইবা হারাবার আছে তার। অতঃপর বিধ্বস্ত বুকের নিচে লালিত দুঃখের পসরাগুলোকে বয়ে বেড়াতে থাকলেন তিনি একজন চিরদুঃখী মানুষের মতো।
অক্টোবর-নভেম্বরের দিকে অবস্থা অনেকটা অনুকূলে আসে। আতংকগ্রস্ত,ভয়-ভীত মানুষগুলো গুটিশুটি মেরে একজন একজন করে ফিরে আসতে থাকে নিজের নিজের পরিত্যক্ত ভিটে মাটিতে। খবর আসতে থাকে সব সীমান্তে হানাদার বাহিনীর প্রতিরক্ষা ব্যুহ ভেঙ্গে পড়ছে। মুক্তিযোদ্ধাদের অগ্রাভিযান হচ্ছে অপ্রতিহত। খবর শুনে দেশের ভেতরের মানুষজন উৎফুল্ল হয়ে ওঠে আনন্দে, আবেগে। আর তিনি, নূরুদ্দিন মাস্টার, পুঞ্জিভূত শোকের ভেতরেও উপলব্ধি করতে থাকেন পরম আনন্দের আতিসহ্য। ঘুম আসে না দুচোখে পাওয়া-না-পাওয়ার ব্যাকুলতায়। অবশেষে আপাদমস্তকে লাল ছোপ ছোপ রক্তের জয়টিকা পরে এগিয়ে আসে বহু প্রতীক্ষিত আর প্রত্যাশিত দিন –১৬ ডিসেম্বর /১৯৭১ সাল। মুক্তিযোদ্ধারা ফিরছে বিজয়ীর বেশে মাতৃভূমিতে। মাঠ-ঘাট ভেঙ্গে তোলপাড় করে। ইথারে ইথারে খবর ছড়িয়ে পড়ে ঢাকায় আত্মসমর্পণ করেছে পরাভূত হানাদার বাহিনী। বিজয়োল্লাসে চারদিক ফেটে পড়েছে বাংলার মানুষজন। যেন সমুদ্রের ফেঁপে ওঠা জোয়ারে ভাসছে সারা বাংলাদেশ।
দ্রুতগামী যানবাহনের গর্জন, কান ফাটানো গোলাগুলির আওয়াজ, বাতাসে বারুদের পোড়া গন্ধ। মির্জাপুর গ্রামের মানুষগুলোর কানেও যায় সে আওয়াজ। বাতাসে ভেসে বেড়ায় গোলাবারুদের গন্ধ। সহস্র-কোটি বছরের অন্ধকার গৃহবন্দি মানুষগুলো যেন আলোর সমুদ্রে অবগাহনের সুতীব্র বাসনায় উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। গ্রামবাসীরা দলে দলে ছুটে যেতে থাকে এশিয়ান মহাসড়কের দিকে, থানা সদর মিঠাপুকুর অভিমুখে।
স্থির থাকতে পারেন না নূরুদ্দিন মাস্টারও। ক্রাচে ভর দিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে মেঠোপথ ভেঙ্গে চলে আসেন বড়ো রাস্তায়। মিঠাপুকুর বাস স্টান্ডে। দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন না, ভাঙ্গা বেঞ্চটাতে বসেন কম্পিত দেহে। ঝাপসা দৃষ্টি মেলে ধরেন পুরু লেন্সের চশমার ভেতর থেকে। ভিড়ের মধ্যে, দূরাগত কনভয়ের মধ্যে খুঁজতে থাকেন প্রিয় আত্মজের পরিচিত মুখ! দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে। পিচঢালা কালো পথের ওপর সীমিত হয়ে আসে যান চলাচল। ছায়ান্ধকার হয়ে আসে বিস্তীর্ণ ধুধু মাঠ, নির্জন বাসস্টান্ড। –“এতো ছেলে ফিরে আসছে যে যার মায়ের কোলে, তুই কেনো ফিরছিস না বাপ”—শুকনো ঠোঁট দুটো থরথর করে কাঁপে তার। স্বগতোক্তি করেন তিনি। শক্তিহীন, অবসন্ন দেহটা কোনোরকমে টেনে তোলেন বেঞ্চ থেকে। ক্রাচে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ান। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগিয়ে যান কিছুদূর। এ সময় জেলা সদরের দিক থেকে ছুটে আসে একটা দ্রুতগামী মোটরযান। গাড়িটার হেড লাইটের তীব্র আলোর বৃত্তের মধ্যে বন্দি হন তিনি। একপাশে সরে দাঁড়াতেই হঠাৎ গাড়িটা ব্রেক কষে দাঁড়ায় তার প্রায় গা ঘেষে। গাড়ি থেকে লাফিয়ে নামে এক যুবক। উস্কখুস্ক মাথার চুল। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। কাঁধে ঝুলছে এস এম জি। ছেলেটি তার বুট জুতোর খট খট শব্দ তুলে এগিয়ে এসে দাঁড়ায় নূরুদ্দিন মাস্টারের সামনে। হাঁটু গেড়ে পায়ের ধুলো নেয়। হা হা শব্দ করে ওঠেন বৃদ্ধ মাস্টার সাহেব। চিনতে পারেন না তিনি ছেলেটিকে। বোবার মতো তার মুখের দিকে চেয়ে থাকেন একদৃষ্টে। –“আমাকে চিনতে পারছেন না স্যার। আমি ফারুক, কোমরগঞ্জের জাবেদ মন্ডলের ছেলে। আপনার ছেলে মঞ্জুর ক্লাসমেট”—বলে ছেলেটি চুপ মেরে যায়।
ফারুক নামের ছেলেটির মুখে মঞ্জুর নাম শুনে ক্ষণিকের জন্য চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে বৃদ্ধের। ভাঙ্গা,জড়িত কণ্ঠে শুধান—“ তুমি কী মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলে বাবা! আমার মঞ্জুও গিয়েছে। ওকে দেখেছো তুমি? ওর ফেরার অপেক্ষায় তো সকাল থেকে সন্ধ্যা অব্দি এখানটায় বসে থাকি আমি ”—বলে হাঁপাতে থাকেন নূরুদ্দিন মাস্টার। উত্তেজনায় তার জীর্ণ ভাঙ্গা বুকটা ওঠানামা করতে থাকে হাঁপরের মতো।
মুখে কিছু বলে না ছেলেটি। নিঃশব্দে একটা ব্যাগ খোলে। তার ভেতর থেকে বের করে একটা ঝরনা কলম, একটা রুমাল এবং একটা রক্তমাখা শার্ট! কম্পিত হাতে জিনিসগুলো এগিয়ে দেয় বৃদ্ধের দিকে। তিনি হাত বাড়িয়ে দেন। তার ঠোঁট কেঁপে ওঠে। থর থর করে কাঁপতে থাকে সারা শরীর। তিনি জিনিসগুলো দুহাতে বুকে চেপে ধরে হাউমাউ করে ডুকরে কেঁদে ওঠেন! তাকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ দেয় না ফারুক নামের মুক্তিযোদ্ধা ছেলেটি । লাফ মেরে গাড়িতে উঠে বসে সে। শাঁ শাঁ শব্দে গাড়ি ছুটে চলে যায় অন্ধকার হাইওয়ে ধরে। আর তিনি! বৃদ্ধ,পঙ্গু নূরুদ্দিন মাস্টার বোবা দৃষ্টি মেলে চেয়ে থাকেন অপসৃয়মান গাড়িটার দিকে। এ মুহূর্তে, অন্ধকারে তার মুখ দেখা যায় না ভালো করে। সামনে পেছনে ডানে বামে অসহায় বোবা জন্তুর মতো ঘাড় নাড়াতে থাকেন তিনি। তারপর এক সময় স্খলিত টলমল পায়ে সুচিভেদ্য অন্ধকার মেঠোপথ ধরে হাঁটতে থাকেন সামনের দিকে। তার ঝাপসা দৃষ্টিপথে কেবলি ভাসতে থাকে একজন মুক্তিযোদ্ধা আত্মজের চিরচেনা প্রিয় মুখচ্ছবি!
নূরুল ইসলাম বরিন্দী, email:nibarindi@gmail.com